শনিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৯


বলিহার রাজবাড়ি

রাজবাড়িতে এখনো আছে দেবালয়, তবে সেখানে হয় না আর নিয়মিত পূজা-অর্চনা দেবালয়ে দেবতার সন্তুষ্টিতে দেবদাসীদের নৃত্যাঞ্জলি, শংখ ধ্বনি, পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ, ধূপের ধোঁয়া আর খোল-করতালের শব্দ থেমে গেছে বহুদিন আগেই
ঐতিহ্য দ্বারা ঘেরা উত্তরবঙ্গের ভারত সীমান্ত ঘেষা বরেন্দ্র অঞ্চল নামে অবহিত নওগাঁ জেলা। এই জেলায় রয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্য পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার (সোমপুর বিহার) শুধু পাহাড়পুরই নয় রয়েছে আরো অনেক ঐতিহ্যে ভরা ঐতিহাসিক স্থান স্থাপনা। তারই একটি অংশ বলিহার রাজবাড়ি। এই রাজবাড়িতে এখন নেই সেই রাজা আর সেই রাজার রাজ্যও। কিন্তু এখনো কথা বলে এই রাজ্যের রাজা জমিদারের সময়কার রোপন করা অনেক বটবৃক্ষ আর তৈরি করা নানা স্থাপনাগুলো। শুধুমাত্র কালের স্বাক্ষী হয়ে রাজার শাসন আমলের স্মৃতি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী বলিহার রাজবাড়িটি
ইতিহাস থেকে জানা যায়, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের এক সনদ বলে নওগাঁর বলিহারের এক জমিদার জায়গীর লাভ করেন। জমিদারগণের মধ্যে জমিদার রাজেন্দ্রনাথ ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে বলিহারে একটি রাজ-রাজেশ্বরী দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মন্দিরে রাজেশ্বরী দেবীর অপরূপা পিতলের মূর্তি স্থাপন করেন। বলিহারের চাকার রথ অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল। প্রাসাদের কিছুটা দূরেই ছিল বিশাল বাগান। বাগানে এখনো কিছু রাজার শাসন আমলে রোপন করা গাছ রয়েছে। বাগানবাড়িটির সামনের পুকুর ঘাটের একটি ছাদ এখনো দঁড়িয়ে আছে। এখানে বসতো নিয়মিত জলসা। বলিহারের রাজাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। রাজা কৃষ্ণেন্দ্র নাথ রায় বাহাদুর একজন লেখক ছিলেন। তাঁর লেখা গ্রন্থগুলির মধ্যে কৃষ্ণেন্দ্র গ্রন্থাবলী ১ম ২য় খন্ড অন্যতম

দেশ বিভাগের সময় এবং জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে অন্যসব রাজার মত বলিহারের রাজার উত্তরাধিকারী বিমেলেন্দু রায় চলে যান ভারতে। এরপর প্রাসাদ ভবনটি রাজ পরিবারের অন্যান্য কর্মচারীরা দেখভাল করতে থাকেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এবং পরবর্তিতে লুট হয়ে যায় রাজবাড়ির বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী মহামূল্যবান নিদর্শন, আসবাবপত্র, জানালা-দরজাসহ বিভিন্ন সামগ্রী। দর্শনীয় প্রাসাদটির কয়েকটি ভবন বর্তমানে কোন রকমে আজো মাথা দাঁড়িয়ে একসময়ের বলিহার রাজাদের ঐতিহ্যের জানান দিচ্ছে
কথিত আছে বলিহারের জমিদারিতে ৩৩০টি দিঘী পুকুর ছিল। এখনো অনেক দিঘী পুকুর রয়েছে। এসব দিঘী পুকুরগুলোর নাম খুবই শ্রুতিমধুর যেমন; মালাহার, সীতাহার, বলিহার, অন্তাহার নানান নামেই ছিল দিঘী পুকুর গুলি পরিচিতি। সৌখিন রাজাদের ছিল মিনি চিড়িয়াখানা। সেখানে ছিল বাঘ, ভাল্লুক, বানর, হরিনসহ নানান প্রজাতির পশু এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি

জনশ্রুতি আছে মোগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিং বার ভুঁইয়াদের দমন করতে এদেশে আসেন। তিনি তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে একপর্যায়ে বলিহার পৌঁছেন। দীর্ঘপথ অতিক্রম করায় সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। বিশ্রামের জন্য মানসিংয়ের প্রেরিত গুপ্তচরের মাধ্যমে বার ভুইয়াদের খবর জানার জন্য যাত্রা বিরতি করেন সেনাপতি মানসিং। ওই সময় চলছিল  বরেন্দ্র অঞ্চলে শুস্ক মৌসুম। বেশিদিন বসে থাকলে সৈন্যরা অলস হয়ে যেতে পারে ভেবে মানসিং সৈন্যবাহিনী দিয়ে ওই ৩৩০টি দিঘী পুকুর খনন করেন। যা এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোটা বলিহার এলাকাজুড়ে

নওগাঁ সদর উপজেলার বলিহার ইউনিয়নে ঐতিহাসিক বলিহার রাজবাড়িটি অবস্থিত। রাজবাড়ির একটি ভবন স্থানীয় একটি স্কুলের পাঠদান কক্ষ হিসাবে ব্যবহূত হচ্ছিল। নতুন স্কুল ভবন নির্মিত হওয়ায় সেখানে স্কুল পার হয়ে যাওয়ায় রাজবাড়ির ভবনটি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। রাজ ভবনটি ৩য় তলা। ভবনের ছাদ থেকে বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টি মেলানো যায়। প্রাসাদ কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত বিশাল দেবালয়টি স্থানীয় হিন্দু সমপ্রদায়ের লোকজন পূঁজা অর্চনা করেন। দেবালয়ে ভিতরে অনেকগুলো কক্ষ আছে। ভবনটি এক সময় দোতলা ছিল

ভবনের উপড়ে উঠবার জন্য দুটি সিঁড়ি আছে। প্রাসাদের সিংহ দুয়ার এখনো অনেকটাই শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাসাদের পিছনের মালিপাড়ায় বিশাল আকারের পাশাপাশি ২টি শিবলিঙ্গ আছে। সেখানে পূজা হয়। প্রাসাদের ভবনগুলি ছিল একটির থেকে অন্যটি কিছুটা দূরে। প্রাসাদ চত্ত্বরের মাঝে ছিল আটচাল। বিভিন্ন পার্বনের দিন গুলোতে অনুষ্ঠিত হতো নাটক, যাত্রা, কবিগান, র্কীত্তনসহ আরো কত কি! আটচালার নিকটতম ভবনের সিঁড়ি গুলো ব্যবহূত হতো গ্যালারি হিসাবে। মূল প্রাসাদের সামনে সতেজ দুটি গাছ আছে। নাম নাগলিঙ্গম। বর্ষা মৌসুমে গাছটিতে ফুল আসে

অনেক আগে নওগাঁ মহাদেবপুর সড়কে বলিহার মোড় থেকে একটি পাকা সড়ক দিয়েই চলাচল করা হতো। সড়কটির দুধারে ছিল বিশাল বিশাল আমগাছ। প্রতিটি গাছের আমই ছিল অত্যন্ত সুস্বাদু। এখনো অনেক আমগাছ আছে রাস্তার দুধারে। বলিহারে সৌখিন জমিদাররা সড়কটি নির্মাণ করেছিলেন। তখন ওই সড়ক দিয়েই রাজশাহীর সাথে নওগাঁ যোগাযোগ করার ব্যবস্থা ছিল। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ওই সড়কই নওগাঁ-রাজশাহীর একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। পরবর্তিতে নওগাঁ-রাজশাহী অভ্যন্তরিন মহাসড়ক নির্মাণ করা হলে বলিহার সড়কটি রক্ষনা-বেক্ষনের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। তবে এখনো সড়কটির কিছু কিছু স্থান অবশিষ্ট আছে।
তবে এলাকার দুর্বৃত্ত আর দখলদারদের অবৈধ দখল আর অত্যাচারে রাজবাড়িটি তার অনেক কিছু নিজস্ব ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। তবে এখনোও যদি এই রাজবাড়িটির অবশিষ্ট অংশটুকু সরকারি ভাবে প্রদক্ষেপ নিয়ে সংস্কার আর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় তবে ভবিষ্যতে এই রাজবাড়িটি একটি ঐতিহ্যবাহি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। আর যদি এই রাজবাড়িটিকে যথোপযুক্ত ভাবে সংস্কার করে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করতে পারি তাহলে সরকার একান থেকে প্রতিবছর রাজস্ব হিসাবে অনেক অর্থ আয় করতে পারবে। তাই সরকারের কাছে এলাকাবাসীদের দাবী যেন অচিরেই এই রাজবাড়িটির যেটুকু অংশ অবশিষ্ট রয়েছে তা অবৈধ দখল মুক্ত করে রাজবাড়িটির সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি করে আধুনিক মানের এক দর্শনীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা হোক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন